আন্তর্জাতিক নারী
দিবস-২০২০
ভাষণ
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন,
ঢাকা, রবিবার,
২৪ ফাল্গুন ১৪২৬, ০৮ মার্চ ২০২০
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
সম্মানিত সভাপতি,
সহকর্মীবৃন্দ এবং
জাতিসংঘের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ, শুক
ইসিকামো ইসিকাওয়া,
উপস্থিত আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিশেষ
করে সমাজের যে সমস্ত নারী প্রতিষ্ঠান তার প্রতিনিধিবর্গ,
উপস্থিত সুধীমন্ডলী,
আসসালামু আলাইকুম।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস
২০২০ উপলক্ষ্যে আমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল নারী এখানে যারা উপস্থিত এবং আমাদের দেশের
অন্যান্য অঞ্চলের যারা আছেন ও সারাবিশ্বের সকলকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আর
নিজের কর্মক্ষেত্রে যারা কষ্ট করে কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন এবং এ বছর যারা জয়ীতা
পদকে ভূষিত হয়েছেন, আমি আপনাদের সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং জয়ীতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের
আমি বলব যে তারা আমাদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভবিষ্যতে আমাদের
নারীরা আরো এগিয়ে যাবে।
মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার
মাস, গতকালই গেছে ৭ই মার্চ জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক
ভাষণ যে ভাষণ আজ বিশ্বের প্রামান্য দলিলে স্থান পেয়েছে, যে ভাষণের মধ্য দিয়ে এ দেশের
মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির বার্তা তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন। ১৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী আমরা উদ্যাপন করব। তিনি আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন,
নারী অধিকার নিশ্চিত করেছেন, সংবিধানে নারীদের অধিকার সমুন্নত রেখেছেন, সেই মহান নেতা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, শ্রদ্ধা জানাই
আমাদের জাতীয় চার নেতার প্রতি, শ্রদ্ধা জানাই ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি দু’লক্ষ মা বোনের
প্রতি। আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানসহ আমার মা, আমার তিন ভাই, দুই ভাই এর নবপরিণীতা ভ্রাতৃবধূসহ যারা শাহাদাৎবরণ
করেছেন তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং সংগ্রামে আমাদের
নারী সমাজের বিরাট অবদান রয়েছে।
১৯৪৮ সাল থেকে যে আমরা
ভাষা আন্দোলন শুরু করি, সে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রামে মেয়েরা
সবসময় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। তাদেরকেও আজকের দিনে আমি স্মরণ করি। আমরা যে নারীরা লেখাপড়া
শিখেছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি, কিন্তু আমাদের যিনি এই পথ দেখিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া,
আমি তার কথা স্মরণ করি। তিনি যদি আমাদেরকে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে না দিতেন তাহলে
হয়তো নারীসমাজ এই সুবিধাটা পেত না। আর বিশেষ করে আমার মায়ের কথা বলব, আমার বাবা জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন।
৪৮ সালে যখন আমাদের ভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, বাংলা বাদ দিয়ে উর্দু চাপিয়ে দেয়ার
চেষ্টা করা হয়েছিল, তখন থেকে তিনি যে সংগ্রাম
শুরু করেছিলেন সেই ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন ছাত্র হিসেবে,
সেই সংগ্রামের পথ বেয়েই কিন্তু ধাপে ধাপে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
আর এই সংগ্রামে সবসময়
পাশে ছিলেন আমার মা। তিনি কখনো সাধারণ নারীদের মত স্বামীর কাছে শাড়ি, গহনা বা কোন কিছুই
দাবী করেন নি বা সংসার চালাবার ঝামেলাও তাঁকে দেন নি। বরং পাশে থেকে প্রেরণা যুগিয়েছেন,
শক্তি যুগিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন কোন
সিদ্ধান্তের প্রয়োজন তিনি অত্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যার জন্য আমরা আজকে স্বাধীনতা
অর্জন করতে পেরেছি। তিনি যে এইভাবে সংসার, নিজের সংগঠন, এই দায়িত্ব না নিতেন আর সেই
সাথে সাথে আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে মানে আমরা যারা ছেলেমেয়েরা ছিলাম আমাদেরকেও মানুষ করার
দায়িত্ব না নিতেন, তাহলে আমার বাবা নিশ্চিন্ত মনে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারতেন
না, এখানেই ছিল তার বিশাল মহাত্ম এবং ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট আপনারা জানেন যে যখন আমার পিতাকে
হত্যা করা হল, আমার মাকে এই খুনীরা একসময় বলেছিল যে আপনি আমাদের সাথে চলেন, আমার মা
কিন্তু তা করে নি। আর জীবন ভিক্ষাও চায় নি, শুধু বলেছে তাঁকে যখন হত্যা করেছ তা আমাকেও
গুলি করে হত্যা কর, আমি তোমাদের সাথে কোথাও যাব না। তারা গুলি করেই হত্যা করেছে আমার
মাকে সেই সাথে আমার তিন ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের। এই হত্যাকান্ড যে শুধু ৩২ নাম্বারে
ঘটে সেটা নয়, একই সাথে আমার মেঝ ফুফুর বাড়ি, সেঝ ফুফুর বাড়ি, ছোট ফুফুর বাড়িও তারা
আক্রমন করে এবং পরিবারের প্রত্যেকটা পরিবারের সদস্য তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
আমি আজকের দিনে আমার
মার কথা বার বার আমার মনে পড়ে। কারণ ৭ই মার্চের ভাষণের কথা আমার মনে পড়ে, যখন চারিদিক
থেকে প্রচন্ড চাপ আমার বাবার উপরে এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে, আমার মা শুধু একটা কথাই
শুধু বলে দিয়ে ছিলেন, যে তুমি সেই কথা বলবে যে কথা তোমার মনে আছে। কারণ তুমি এই বাংলার
মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছ, আপনারা ৭ই মার্চের ভাষণ শোনেন আপনারা দেখবেন, হাতে কোন
কাগজ নেই, কোন নোট নেই, কিছুই নেই। যে কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মনে ছিল তিনি কিন্তু
সেই কথাই বলেছিলেন, যা আজকে সারা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আজ ইউনেস্কো স্বীকৃতি
দিয়েছে।
আজ বাংলাদেশ সম্মান
পেয়েছে, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই জাতির পিতা নারী অধিকার নিশ্চিত করবার পদক্ষেপ
নিয়েছিলেন আমাদের সংবিধানে। তিনি শুধু পুরুষের অধিকার নয় নারীদের অধিকারের কথা সমানভাবে
বলেছিলেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, অনুচ্ছেদ ২৮ এর ৩ এ ২৮ এর ২ সেখানেও তিনি সমানভাবে
নারী-পুরুষের অধিকারের কথা বলে গেছেন। এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ একটা সংবিধানে নেওয়া সেই সময়কার
সামাজিক পরিবেশে বা রাজনৈতিক পরিবেশে একটা কঠিন কাজ ছিল, সেই কাজটাও তিনি করে দিয়ে
গিয়েছিলেন। কারণ একটা কথা সবসময় তিনি বলতেন, আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করব আপনারা যদি তার
লেখা কিছু ডায়েরি, যেমন ১৯৫২ সালে তিনি চীন ভ্রমণে গিয়েছিলেন, চীনে গিয়েছিলেন একটি
শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ করবার জন্য। সেখান থেকে ফিরে আসার পর ৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট
জয়ী হলে তখন মন্ত্রী হন, কিন্তু সেটা বেশীদিন টেকে নাই। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন
আবার তিনি ৫৪ সালে বন্দি হন এবং সেই বন্দি দশায় বসে তিনি ৫২ সালে যে চীন ভ্রমণ করেছেন
এই বইটা তিনি লিখেছিলেন, যেটা আমি এবারে বই মেলায় এটা প্রকাশ করেছি। আপনারা যদি সেই
বইটা পড়েন সেখানে দেখবেন যে তিনি শুধু চীন দেখেছেন তা না, নারী অধিকার সম্পর্কেও তিনি
অনেক কথা সেখানে লিখে গেছেন যা মনে হয় যেন এখন বর্তমান যুগেও এই কথাগুলি অত্যান্ত প্রযোজ্য
এবং অত্যন্ত বাস্তব সত্য।
তিনি সবসময় একটা কথা
বলতেন, যে মেয়েদের অধিকারের কথা শুধু বললে হবে না, অর্থনৈতিক অধিকার প্রয়োজন। একটি
মেয়ে যদি নিজের পায়ে দঁড়াতে পারে, নিজে অর্থ কামাই করতে পারে, তাহলে সংসারে তার একটা
অবস্থান হয়। পরিবারের কাছে তার গুরুত্ব বাড়ে। তিনি আমাদের দেশী ভাষায় এভাবে বলতেন,
যে একটা মেয়ের যদি দিন শেষে আঁচলে ১০টা টাকা বেঁধে ঘরে আসতে পারে, ১০টা টাকা হাতে তার
আঁচলে বাঁধা থাকে তাহলে তাঁকে আর কেউ পরিবারে অবহেলা করতে পারে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক
স্বাধীনতার কথাই তিনি বলে গেছেন। কাজেই দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি কিন্তু শুধু মুখের
বলা না, তিনি সে অধিকারটাও দিয়ে গেছেন আমাদের বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য।
আওয়ামী লীগ একটি সংগঠন,
আমার মনে হয় আমাদের দেশে একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন আমরা প্রথম আমাদের গঠনতন্ত্রে আমরা
নারীদের অধিকারের কথা এবং আমাদের যে মেনুফেষ্টু পাঠে বা ঘোষণাপত্র সেখানেও আমরা নারী-পুরুষের
সমান অধিকারের কথা সেখানে উল্লেখ করেছি। এটা আর কোন সংগঠন আর কোন পার্টি কিন্তু এ ধরনের
লিখতে পারে নি যেটা আমরা করেছিলাম। কাজেই একটা কথা আমরা বিশ্বাস করি যে নারীরা যত শিক্ষিত
হবে, নারীরা যত স্বাবলম্বী হবে এবং তারা সমাজ তত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে। কারণ সমাজের
অর্ধেক অংশকে মানে একেবারে অকেজো রেখে দিয়ে একটি সমাজ সঠিকভাবে চলতে পারে না। ফলে সে
সমাজ খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলবে।
তবে এটা ঠিক যে নারীরা
সবসময়ই নানা ধরনের যন্ত্রণার শিকার হয় সেটা আমরা দেখেছি এবং সেটা মোকাবেলা করার জন্য
আবার বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছি। আমরা সেভাবে বিভিন্ন আইনও করেছি এবং আইনগতভাবে আমরা
সেই ধরনের শাস্তির ব্যবস্থাও করি, তারপরেও অনেক সময় নারীদের উপর নির্যাতন হয়। কিছুক্ষণ
আগে আমরা পুরস্কার দিলাম আমার এসিডদগ্ধ একটি বোনকে। আমরা কিন্তু এই এসিডের বিরুদ্ধে
আইন করেছিলাম, এমনকি মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে যেন তাৎক্ষণিকভাবে সাজাপ্রাপ্ত হয়, সেই
ব্যবস্থা যেমন করেছি, আবার মামলা করে যে এসিড মেরেছে তাকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া সেই ব্যবস্থাটা
আমরা করেছি এভাবে আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম। ইদানিং আমরা একটু দেখি নারী ধর্ষণের বিষয়টা
শুধু বাংলাদেশ বলে না, এটা বিশ্বব্যাপীই কিন্তু একটা সমস্যা। কাজেই আমি এটা মনে করব
যে এখানেও আমাদের যেমন একদিকে সচেতনতা দরকার আর সেই সাথে সাথে আমাদের পুরুষ শ্রেণি
যারা তাদেরকেও একটু এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এই নারী ধর্ষণকারী তো পুরুষরাই, কাজেই পুরুষ
সমাজের পক্ষ থেকেও আমরা চাই যে তাদেরকেও সোচ্চার হতে হবে যে যারা এই ধরনের নারীদের
উপর পাশবিক অত্যাচার করে তারা যে একটা সমাজের সবথেকে জঘন্য একটা মানে আমি এখন একটা
মানুষ বলতে ইচ্ছা করে না। বলতে ইচ্ছে করে একটা পশুরওঅধম। কাজেই তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের
পুরুষ সমাজকেও ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ আমরা দেখেছি যে এই বাংলাদেশে ৭১ সালে পাকিস্তানী
হানাদারবাহিনী যখন আমাদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছিল সেইসময় মেয়েদের উপর কিভাবে পাশবিক
অত্যাচার করেছিল। সেইসময় যারা এই পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর দোষর ছিল, যারা পাকিস্তানী
হানাদারবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল বা তাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম পথ
চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমার দেশের মেয়েদেরকে এই হানাদার পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছিল
এবং দিনের পর দিন তারা মেয়েদের উপর পাশাবিক অত্যাচার করত, ক্যাম্পে নিয়ে রেখে দিত এবং
তাদের এমনও কথা ছিল যে তারা সাচ্চা পাকিস্তানী বানাইয়া দিয়ে যাবে। এইভাবে মেয়েদের উপর
যে পাশাবিক অত্যাচার করেছে, যখন পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর স্যারেন্ডার
করল, এরপর যখন এই বিভিন্ন ক্যাম্পের থেকে এই নির্যাতিতা মেয়েদেরকে উদ্ধার করা হচ্ছিল,
অনেকেই তখন পেগন্যান্ট ছিল, মানে অনেকে অসুস্থ মানসিক, ভারসাম্যহীন, তখন একটা ভয়াবহ
চিত্র ছিল। জাতির পিতা নারী পুনর্বাসন বোর্ড করে দেন এবং এই নারীদের চিকিৎসার জন্য
তিনি সুইজারল্যান্ড থেকে, ইংল্যান্ড থেকে, জার্মানী থেকে ডাক্তার, নার্স নিয়ে আসেন
এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং তাদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তিনি এই
নারীদেরকে সম্মাননা দেন বীরাঙ্গনা হিসেবে উপাধিতে ভূষিত করে। যে তাদের মহান অবদান রয়েছে
আমাদের স্বাধীনতায় সেইজন্য। কিন্তু তাদের যখন বিয়ে দিতে যায় তখন একটা দেখা যায় আসলে
আমাদের তখনো এখনকার যুগের মত এতটা মানে মানুষ তখনো খোলামেলা হয় নি, যে একটা মেয়ে পাশবিক
নির্যাতনের শিকার হলে মামলা করতে পারে বা নালিশ করতে পারে বা বলতে পারে, তখন এই বলাটাও
ছিল একটা লজ্জার ব্যাপার সামাজিক লজ্জার ব্যাপার। তাহলে ঐ বাবা, মাকে একঘরে করে ফেলা
হত। অনেক বাবা মা তাদের পরিচয় দিতে চায় নি, মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় নি। যখন
এদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হল, আমার মা নিজে উপস্থিত থেকে সেই বিয়ে দিয়েছিলেন এবং তখন
প্রশ্ন উঠেছিল যে বিয়ের কাবিননামায় বাবার পরিচয়টা কি লিখবে। জাতির পিতা বলে দিয়েছিলেন,
লিখে দিবে পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, বাড়ি ৩২ নম্বর, ৬৭৭ নাম্বার বাড়ি, ৩২ সম্বর
সড়কে ধানমন্ডি। ঠিক সেইভাবেই তাদেরকে পুনর্বাসন করা হয়েছিল এবং যে সমস্ত শিশু যেগুলি
এবর্শন করা সম্ভব ছিল, করা হয়েছিল, আর যারা জন্মগ্রহণ করেছিল অনেকেই তখন পৃথিবীর বিভিন্ন
দেশ থেকে দত্তক নিয়েছিল তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সে মেয়েগুলিকে পুনর্বাসন করে।
আবার অনেক বাবা মা তার সন্তানকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আসলে তখনকার সমাজ ব্যবস্থাটাই ছিল
এমন যে কোন বাবা নিলে তার অন্য মেয়েদের আর বিয়েই হবে না, বা তাদেরকে খুব একটা ঘৃণার
চোখে দেখা হত। অথচ এই মেয়েদেরতো কোন দোষ ছিল না। কাজেই মন মানসিকতা পরিবর্তন অত্যন্ত
একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আজকে অবশ্য ধীরে ধীরে
সেই মানসিকতা অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মেয়েদের অধিকারের জন্য তিনি সরকারি চাকুরিতে
১০ পার্সেন্ট কোটা নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন। আর বিশেষ করে এই নির্যাতিত মেয়েরা তারা যদি
লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তাদেরকে অবশ্যই চাকরি দিতে হবে সেই নির্দেশনাও বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব দিয়েছিলেন। পাশাপাশি মেয়েরা যেন সর্বক্ষেত্রে চাকরি পায়, যেমন আমাদের জুডিশিয়াল
সার্ভিসে পাকিস্তান আমলে আইন ছিল কোন মেয়ে জুডিশিয়াল সার্ভিসে বসতে দিতে পারবে না,
বা যেতে পারবে না। তিনি কিন্তু সকল আইন পরিবর্তন করে দেন এবং সেখানে মেয়েদের জন্য সব
উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। যেহেতু সংবিধানে অধিকার দিয়েছেন, পাশাপাশি সেই ক্ষেত্রে এবং
আমাদের পার্লামেন্টে সংরক্ষিত আসনকরে দেন যেন নারী নেতৃত্ব গড়ে ওঠে, সেই জন্যই তিনি
সেটা করে দিয়েছিলেন। নারী শিক্ষা অবৈতনিক করে দিয়েছিলেন।
সেই সময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত
দেশ, এটা ১৯৭৩ সালে প্রথম এই নারী দিবস পালন করা শুরু হয়। বোধহয় ৭২ সাল থেকেই তিনি
বলেছিলেন এটা উদযাপন করতে কারণ আমাদের আওয়ামী লীগে তখন অনেক নারী নেতৃত্ব ছিল। কাজেই
তাদেরকে বলেছে এটা সব আয়োজন করতে। তারা সেভাবে করেন এবং ৭৩ সালে প্রথম এই নারী দিবস
পালন শুরু হয়। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে তিনি আমাদের একটা সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমি ৯৬ সালে
যখন সরকারে আসি, আমি দেখেছিলাম যে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে নারীদের কোন স্থানই নাই। আমাদের
পুলিশবাহিনী বলেন বা প্রশাসনে বলেন বা অনেক জায়গায় আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী
এমনকি বর্ডারগার্ড। নারীদের একমাত্র মেডিকেল কোর ছাড়া আর কোথাও তাদের চাকরির সুযোগ
ছিল না। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নেই যে আমাদের এই তিনবাহিনীসহ এবং পরবর্তীতে বর্ডার গার্ডেও।
আর পুলিশে কিন্তু জাতির পিতাই প্রথম তখন ৭ জন নারীকে পুলিশে অফিসারের চাকুরি দিয়ে যান।
অর্থাৎ মেয়েদের ঢোকার একটা সুযোগ তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন পুলিশবাহিনীতে। ঠিক এইভাবে
প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের মেয়েরা কাজের সুযোগ পায়, কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হয় সেই ব্যবস্থাটা
আমরা করে দিয়েছি।
মায়ের নামে আসলে বাবার
নামেই সব পরিচয় মায়ের নাম ছিল না। কিন্তু একটা সন্তানের পরিচয় মায়ের নাম সেটাও আমি
অন্তর্ভূক্ত করে দেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র তিন মাস ছিল, আমি প্রথমবার যখন সরকারে
আসি তখন চার মাস করি, দ্বিতীয়বার এসে আমি ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি করে দিয়েছি। পাশাপাশি
নারীদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে যেন আমাদের নারী প্রতিনিধিরা সুযোগ করতে পারে। আমরা বৃত্তি
দেই আমাদের শিক্ষার্থী আমাদের প্রায় ৪ কোটির উপর শিক্ষার্থী তার মধ্যে ২ কোটি ৪ লক্ষ
শিক্ষার্থী আমাদের কাছে বৃত্তি এবং উপবৃত্তি পায়। এর মাঝে ১ কোটি ৩০ লক্ষ শিক্ষার্থী
যারা প্রাইমারী স্কুলের তারাও বৃত্তি পায়, তাদের বৃত্তির টাকাটা মায়ের নামে মোবাইল
ফোনের মাধ্যমে সরাসরি মায়ের কাছে পৌঁছে দেই।
আমাদের খেলাধুলা এই
খেলাধুলায় আপনার ফুটবল বলেন, ক্রিকেট বলেন বা অন্য সব খেলাধুলায় মেয়েরা যাতে অংশগ্রহণ
করতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলাম প্রথমবার সরকারে এসে যথেষ্ট বাঁধার সৃষ্টি
হয়েছিল। প্রথমবার যখন আমরা প্রমিলা ফুটবল নাম দিয়েছিলাম। এই প্রমিলা ফুটবলের কম্পিটিশন
করতে যেয়ে প্রচন্ড বাঁধার সম্মুখিন হই। কোন কোন জেলায় তো সেই খেলা অনুষ্ঠিতই হতে পারে
নি এমন বাঁধা এসেছিল, দ্বিতীয়বার সরকারে এসে প্রাইমারী লেভেল থেকে আমরা এই খেলার কম্পিটিশন
শুরু করি। আজকে আপনারা দেখেন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এবং আঞ্চলিকভাবে আমাদের মেয়েরা খেলাধুলায়
তাদের পারদর্শীতা দেখাতে সক্ষম হচ্ছে।
ভারত্তোলন থেকে শুরু
করে সর্বক্ষেত্রে একেবারে এভারেস্ট বিজয় পর্যন্ত আমাদের মেয়েরা করে ফেলেছে। কাজেই স্পোর্টস
এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা মেয়েরা করে আমরা তাদের সব ধরনের উৎসাহ দেই যাতে আমাদের মেয়েরা
এগিয়ে যায় এবং মেয়েরা যে পারে সেটা আজ মানে প্রমাণিত। আমাদের হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টে
কোন মেয়েরা ছিল না। কোন জজ বা কোন প্রমোশনই পায় নি। আমি বলেছিলাম আমি কোন সাধারণত মহামান্য
রাষ্ট্রপতি জজ নিয়োগ দেন। আমি প্রথমবার যখন সরকারে তখনই আমি রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলাম
যিনি ছিলেন যে আপনি যখনই সিলেক্ট করবেন এখানে অন্তত মহিলা জজ নিয়োগ দিতে হবে এবং সেই
থেকে কিন্তু শুরু এখন আমাদের অনেক আছে জজ। তো এভাবে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা মেয়েদের
সুযোগ করে দিচ্ছি এবং আমাদের মেয়েরা যেখানেই যাচ্ছে তাদের পারদর্শীতা দেখাচ্ছে। শান্তিরক্ষা
মিশনে আমাদের পুলিশবাহিনীর একটি কন্টিনেন্ট আছে কঙ্গোতে ওখানে তারা খুব ভাল কাজ করছে,
তাতে আমাদের মেয়েরাও মেয়েদের ডিমান্ডটা কিন্তু এখন বেড়ে গেছে শান্তিরক্ষা মিশনে সেহেতু
গোপন কথা বলে দিচ্ছি, প্রকাশ্যেই বললাম তো সব এখন মেয়ে অফিসারই চাই। সেটা আসে মানে
আমাদের সশস্ত্রবাহিনী বা সেনাবাহিনী এবং পুলিশবাহিনী যেখানেই হোক মেয়ে অফিসারদের বা
মেয়েদেরকে বেশী যাচ্ছে তারা কারণ মেয়েরা অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। ছেলেরাও
করছে আমি বলবো না ছেলেরা করে না, ছেলেরাও করে কিন্তু মেয়েরা ভাল করছে এতে কোন সন্দেহ
নেই। আমি সত্যি এই জন্য অত্যন্ত গর্বিত।
কাজেই আমি আমাদের এখন
জেন্ডার গ্যাপ দিয়ে একটা প্রশ্ন আছে সারা বিশ্বব্যাপী। আমাদের সমস্যার কিন্তু উল্টে
গেছে, কারণ আমাদের এখন শিক্ষার্থী ছাত্রীর সংখ্যা বেশী হয়ে গেছে ছাত্রের সংখ্যা কম।
কাজেই আমরা যদি এখন ছাত্রছাত্রীর তুলনা করি আমি দেখি সেখানে ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশী
এবং পাশও করে তারা ভাল রেজাল্টও ভাল করে কাজেই ছেলেরা কেন পিছিয়ে আছে আমাদের এখন জেন্ডার
গ্যাপ পুরন করার জন্য এদিকটা নজর দিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত আমি বলব, এটার দিকে
বিশেষভাবে নজর দেওয়া যে, ছেলেরা কেন পিছিয়ে আছে এটা আমাদের এখন ঠিক করতে হবে। যাহোক
আমরা আমি আর সময় নিতে চাই না, এরপর কালচারাল অনুষ্ঠান আছে সেটাও দেখব। আমরা বলব যে
আমরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা স্বামী পরিত্যাক্তাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছি তার
কারণ তাহলে পরিবারের কাছে আমাদের মেয়েদের একটা অবস্থান থাকে সেই লক্ষ্য নিয়েই। এভাবেই
মেয়েদের জন্য আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, আর তাছাড়া আমরা কর্মজীবী
মেয়েদের জন্য হোস্টেল করে দিচ্ছি। ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করছি, সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা
আমরা মেয়েদের জন্য দিয়ে যাচ্ছি। কাজেই আমরা চাই এবং মেয়েরা যাতে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার সৃষ্টি করা, পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন থাকা এই সব দিকেই আমরা দৃষ্টি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
আমরা চাই যে আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এগিয়ে যাবে। পার্লামেন্টে
আমরা আছি আমি এবারে আমাদের বিরোধী দলের নেতা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন যে নারীদের ক্ষমতায়ন।
তারমানে ওনাকে দেখালাম আমরা বসে আছি স্পিকার নারী, সংসদ নেতা নারী, উপনেতা নারী, বিরোধী
দলের নেতা নারী, কাজেই সেখানে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলের নেতা কি করে বলেন যে মেয়েদের ক্ষমতা
নাই। তবে ক্ষমতা জোর করে হয় না, ক্ষমতা নিজের যোগ্যতায় অর্জন করে নিতে হয়, কেউ হাতে
তুলে ক্ষমতা দেয় না, সেটাই আমি বলব। কবি নজরুল বলে গেছেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি
চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” এম বাস্তব কথাটা তিনি বলে
গেছেন। কাজেই এই কথাটা মাথায় রেখেই আমাদের বোনদেরকে নিজেদেরকে তৈরি করতে হবে, আর এখন
তো শিক্ষায় দীক্ষায় সব ক্ষেত্রেই আমাদের মেয়েরা যথেষ্ট অগ্রগামি ভূমিকা নিচ্ছে এভাবেই
আমরাই এগিয়ে যাব সেটাই আমরা চাই। কাজেই আমি নারী দিবসে সকলকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন
জানাই, শুভেচ্ছা জানাই এবং সেই সাথে আমি বলব যে বাংলাদেশ আজকে আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে
যাচ্ছে, এই গতিধারাটা আমাদের অব্যাহত রেখে চলতে হবে যেন বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা আর
যেন থেমে না যায়। আমরা মুজিব বর্ষ উদ্যাপন করছি, জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে
গেছেন তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী আগামী ১৭ই মার্চ থেকে উদ্যাপন শুরু করব, আমরা যেন সফলভাবে
করতে পারি সেটাই আমি সকলের সহযোগিতা কামান
করি।
আরেকটি সমস্যা সারা
বিশ্বব্যাপী এখন সেই করনা ভাইরাস, এই করনা ভাইরাস করতে করতে অনেক দেশ এখন অর্থনেতিকভাবেও
সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে। আমরা কিন্তু সারাক্ষণ মনিটর করছি যে কোথাও যদি কোন সমস্যা
দেখা দেয় সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে এই ক্ষেত্রে আমি বলব সবাইকে পরিস্কার
পরিচ্ছন্ন থাকা এবং ইতিমধ্যে প্রতিদিন কিন্তু আমাদের মানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে
প্রতিদিনই নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে যে, কিভাবে চলতে হবে, কিভাবে কাজ করতে হবে। সবাইকে সেই নির্দেশনাগুলি মেনে চলার জন্য আমি অনুরোধ করব।
যে প্রত্যেকে যদি এ ব্যাপারে একটু সচেবতনতা মানে সৃষ্টি করতে পারে এবং সেভাবে মেনে
চলতে পারেন ইনশা আল্লাহ আমরা এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে যথেষ্ট আমরা যে সক্ষমতা
আছে আমরা তা পারব। কাজেই এখানে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। কারণ আমরা মনে করি যে আমাদের মানে
স্বাস্থ্য সুরক্ষার এই নির্দেশনাগুলি সকলকে মেনে চলার আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। এই বলেই
নারী দিবসে সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য এখানে শেষ করছি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
...